22 Nov 2025 +880 1886 456688
image

Article Details

গণমাধ্যম ও মানবাধিকার
Abdullah Al Monjur Hossain 13 May 2024
image

ডঃ আব্দুল্লাহ্ আল্ মন্জুর হোসেন

 সহযোগী অধ্যাপক

আইন বিভাগ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি


মানবাধিকার শব্দটি বহুল আলোচিত ও বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। মানবাধিকারের বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও অলঙ্ঘনীয় হলেও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এ নিয়ে চলছে বাক-বিতণ্ডা ও দ্বন্দ-সঙ্ঘাত। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা।

 

বাংলাদেশের সংবিধানে “মানবাধিকার” রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রদত্ত মানবাধিকারসমূহ ছিল মর্যাদা, সুযোগ লাভ ও ধর্মপালনের অধিকারের সমতা; আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের সমতা; ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও বাঁচার অধিকার সুরক্ষা; অযৌক্তিক গ্রেফতার বা আটক, বিচার বা দন্ড থেকে সুরক্ষা; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশে বহু জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব তূলনামূলকভাবে কম, একটি নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের সংখ্যাধিক্য ব্যাপক হওয়ায় এদেশ অপেক্ষাকৃত সমজাতীয় বলে বিবেচিত। সে কারণে পাকিস্তান ও ভারতের মতো এদেশের সংবিধানে জাতীয় সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা বিধান রাখা হয় নি। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে ইংরেজদের সে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাতে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, সকল শ্রেণি একটি অভিন্ন আইনের অধীন, যে আইন কার্যকর হবে সাধারণ আদালতের মাধ্যমে; জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে সে আইনের প্রয়োগ হবে সমান। এ মতবাদের আইনগত দিকটি আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত যেকোনো দেশেই একটি মৌলিক বিষয়। সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদেও এটা সুস্পষ্ট করা হয়েছে; সেখানে সরকারি চাকুরিতে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনো নাগরিক কোনোরূপ বৈষম্যের শিকার হবে না। এটা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় প্রয়াসের ইঙ্গিতবহ। কিছু সীমাবদ্ধতাসহ সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধানের ৪২(১) অনুচ্ছেদে।

 

আইনের শাসন  রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সকল ক্রিয়াকর্ম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ব্যবহারিক ভাষায় আইনের শাসনের অর্থ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সর্বদা আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যেকোন নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। মোট কথা, আইনের শাসন তখনই বিদ্যমান থাকে, যখন সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন সাধারণ আদালতের পর্যালোচনাধীন থাকে, যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সকল নাগরিকের সমান।দেশভেদে আইনের শাসনের বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। ইংল্যান্ডে যেসব সাধারণ নীতি দ্বারা আইনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে তার অধিকাংশই সেখানকার নাগরিকদের আদালতে উত্থাপিত বিভিন্ন মামলার বিচার বিভাগীয় রায়ের ফসল। ওইসব রায়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার নির্ধারিত হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাগনা কার্টা (১২১৫), দ্য পিটিশন অব রাইটস (১৬২৮) এবং বিল অব রাইটস (১৬৮৯)-এ ইংরেজদের স্বাভাবিক অধিকারসমূহ ঘোষিত হয়েছে, যা ওই দেশের আইনের শাসন নিশ্চিত করে। ইংরেজ জাতির ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ব্যবহারবিধি এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে ইংরেজদের সচেতনতা গড়ে উঠেছে। সেগুলো পরবর্তীকালে সৃষ্ট অনেক নতুন রাষ্ট্রের লিখিত সাংবিধানিক দলিলের মতোই পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়। অধিকাংশ নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে ইংরেজদের ওইসব অলিখিত নীতিমালা সন্নিবেশিত হয়েছে ।

 

সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সীমিত শাসন ও আইনের শাসনের ধারণাটি দৃঢ়তর হয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তির বাঁচার অধিকার ও স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকারসমূহের মর্মবস্ত্ত নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাহি বিভাগের কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার অনুপস্থিতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের অঙ্গীকার রয়েছে এখানে। শর্তারোপ করা হয়েছে যে, দেশের সাধারণ আদালতে সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত কোনো আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে দন্ড দান করা চলবে না, বা আইনের দ্বারা দৈহিক বা বৈষয়িকভাবে কোনো ব্যক্তির ভোগান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার্থে একজন নাগরিক আইনের সুরক্ষার অধিকার রাখে।গ্রেফতারের আইনসঙ্গত ভিত্তি ছাড়া কোনো নাগরিককে আটক রাখা যাবে না, তার আইনি পরামর্শ লাভের অধিকার বা উকিল দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নাকচ করা যাবে না, তাকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে এবং আদালতের আদেশ ছাড়া তাকে অধিক সময় আটক রাখা যাবে না। এসব অধিকার কার্যকর করার ক্ষমতা উচ্চতর আদালতগুলোকে দেয়া হয়েছে। আদালতসমূহ তাদের সংশ্লিষ্ট আইনগত এখতিয়ারের মধ্যে নির্দিষ্ট রিট জারি করতে পারে, যথা হেবিয়াস কর্পাস, ম্যান্ডামাস, প্রোহিবিশন, কু ওয়ারান্টো

 

ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটিতে রাষ্ট্র যখন তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে যদি কোথাও ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে সেই ব্যত্যয়গুলো গণমাধ্যম তুলে ধরে গণমাধ্যম হচ্ছে সংগৃহীত সকল ধরণের মাধ্যম, যা প্রযুক্তিগতভাবে গণযোগাযোগ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সম্প্রচার মাধ্যম যা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নামে পরিচিত, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে তাদের তথ্যাবলী প্রেরণ করে ।  বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে গণমাধ্যমকে প্রধান ৮টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো - বইসংবাদপত্রসাময়িকীধারণ যন্ত্ররেডিওসিনেমাটেলিভিশনএবং ইন্টারনেট। বিংশ শতকের শেষ এবং একবিংশ শতকের শুরুতে গণমাধ্যমের প্রকারভেদ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, গণমাধ্যমের বিভাজন সুস্পষ্টভাবে আরও বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যেই সেল ফোনভিডিও গেম এবং কম্পিউটার গেমসকে গণমাধ্যম হিসেবে উপস্থাপনা করায় বিতর্ক চলছে। 

 

কোনো রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশ ভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে; এতে আরেকটি প্যারাডক্স জন্মনেয়- যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, যে সাংবাদিক সরকারের ভুলচুক নিয়ে নিয়ত রিপোর্ট করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা সেই সাংবাদিকের নিরাপত্তা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। অনেকটা সংসদে বিরোধী দলের অবস্থানের মতো, তারা সংসদে সরকারের কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা করবে, তারা যেন সংসদে তা সুষ্ঠুভাবে করতে পারে, সেই সুযোগ সরকারি দলকেই নিশ্চিত করতে হবে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি কিন্তু তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’- ভলতেয়ারের এই উক্তিই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌল চেতনা; এই চেতনা আর এর চর্চার ভিতরেই লুক্কায়িত থাকে গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। তো গণতন্ত্রের পথচলায় গণমাধ্যম কী করতে পারে? গণমাধ্যম নাগরিকদের বহুমুখী যোগাযোগের পাটাতনটি তৈরি করে দেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানে যেহেতু খোলা সমাজ, তাই মানুষকে এখানে বহু স্তরে বহু পর্যায়ে বহু ধরনের তথ্য আদান- প্রদান করতে হয়। গণমাধ্যম মানুষের জন্য তথ্যের বৃহত্তর প্রবেশগম্যতা তৈরি হয়।

Comments:
img